একটা ছেলে যখন একটা মেয়েকে নক দেয়, প্রথম দুই একদিন মেয়েটি কিছু না বললেও কয়েকদিন যেতেই মেয়েটি ছেলেটির সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে দেবে, অপমান করবে, রাগ দেখাবে অথবা ছেলেটার কোনো কথার আর কোনো উত্তর দেবে না। একটা ভদ্র ছেলে কোনোভাবেই ঐ অপমান সহ্য করতে পারবে না। সে রাগে ঐ মেয়েকে আর জীবনেও নক দেবে না। কিন্তু একটা বাউলা ছেলে বলবে, মেয়েরা প্রথম প্রথম এমনই করে, কয়েকদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে। সে নিয়মিত নক করেই যাবে। প্রতিদিন নানান রকমের অভিনয় করে কথা বলবে। নানান ভাবে ভালোবাসার কথা বলবে। আর সেই অভিনয়গুলো মেয়েটির কাছে দারুণ লাগবে। মনে মনে বলবে এমন একটি ছেলেই তো চেয়েছিলাম জীবনে। টাকা পয়সা যোগ্যতা দিয়ে কি হবে যদি আমাকে ভালোই না বাসে। এরকম ভালোবাসাই আমি চেয়েছিলাম। বন্ধু বান্ধবদের কাছে গর্ব করে বলবে জানিস সে অনেক কেয়ারিং, আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। সারাক্ষণ ফোন দেয়। ঐদিন একটা নীল পাঞ্জাবী পড়ে এসেছিল। কত যে ভালো লেগেছিল। আমিও একটি লাল শাড়ি পড়েছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল যেন দুজন আমরা স্বামী স্ত্রী। জানিস আমার জন্য কি সুন্দর একটি গিফট এনেছিল। আমিতো দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক যেন আমার পছন্দের জিনিসটা আমাকে এনে দিয়েছে। হ্যাঁ ঐ আমার জীবনের সব। অন্য কেউ কি আমার মন কি চায় তা বুঝতে পারে।

 

আরও জানিস ঐদিন শয়তানি করে বলেছিলাম আমার ‘করিমের বিরিয়ানি’ খুব প্রিয়। কি অবাক কান্ড, সন্ধ্যা বেলা দেখি হঠাৎ ফোন দিয়েছে। বলে, একটু নিচে আসো। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন, সে বলে আসোনা একটু, আসলেই বুঝতে পারবে। মোবাইলটা টেবিলে রেখে আব্বু-আম্মুর রুমে গেলাম দেখি আব্বু বাসায় আছে কিনা। দেখলাম আম্মু একা আব্বু বাইরে গেছে। আম্মুকে বললাম, আম্মু খুব খুধা লাগছে একটু নিচে যাই কিছু খেয়ে আসি। আম্মু বলল, ঠিক আছে যা, তাড়াতাড়ি আসিস। তোর আব্বু বাসায় এসে তোকে না দেখলে খুব রাগ করবে। ঠিক আছে আম্মু আমি এখনই চলে আসবো।

 

ওয়াশরুমে গিয়ে কোনোরকম ড্রেস পাল্টিয়ে অনিকাকে নিয়ে নিচে গেলাম। দূরে থেকেই দেখি রহিমের হাতে একটি ব্যাগ। আরও সামনে গিয়ে আমিতো রীতিমতো অবাক। দেখি প্যাকেটের গায়ে লেখা ‘করিমের বিরিয়ানি’। আনন্দে মনটি যেন একবারে ভরে উঠল। হ্যাঁ এমন বরই তো আমি চেয়েছিলাম। এ যেন আমার স্বপ্নের পুরুষ। নীল পাঞ্জাবীওয়ালা। এর মধ্যেই হঠাৎ মনে হচ্ছে আমি মনে হয় পাতায়া সুমুদ্র সৈকতে আছি রহিমের সাথে। রহিম সাগরের জল ছিটিয়ে দিচ্ছে আমার গায়ে আর আমিতো আনন্দে আত্মহারা। যেন স্বর্গে আছি। হঠাৎ রহিম বলল, এ কি তুমি ঐদিকে তাকিয়ে কি ভাবছ? আমি রহিমের দিকে তাকিয়ে চোখটি একটু বাঁকা করে বললাম, দাও দাও প্যাকেট দাও। বাহ! ব্যাগের মধ্যে ২ টি বিরিয়ানি। জিজ্ঞেস করলাম, দুটি কেন? রহিম অনিকার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কেন? অনিকার জন্য একটা। অনিকার যেন খুশিতে নাই। অনিকাও মনে মনে বলছে আমার জন্য আল্লাহ যেন এমন একটা বর রাখে। কিরে অনিকা কি ভাবছিস মনে মনে। প্যাকেটা নে। আমি এবার রহিমের দিকে তাকিয়ে আবার বললাম ২ টা কেন? রহিম একটু বিরক্তিসুরে বলল’ বললাম তো আনিকার জন্য একটা। আমিও একটু বিরক্তসুরে বললাম, তোমারটা?

রহিমের মুখটি কেমন যেন একটু কালো দেখালো। কিন্তু তার মধ্যেই হেসে দিয়ে বলল, আমি একটু আগেই বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। আমি বুঝে নিলাম ওর পকেটে হয়তো টাকা কম ছিল। টাকা নেই পকেটে তারপরেও একটি নয় দুটি বিরিয়ানি এনেছে। খুব মায়া হলো রহিমের জন্য। ভালোবাসায় যেন হৃদয়টি ভরে গেল। মন চেয়েছিল বিরিয়ানির প্যাকেটটি খুলে নিজের হাত দিয়ে একটু খাইয়ে দেই। কিন্তু বাসার নিচে দাঁড়িয়ে খাওয়াতে গেলে কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে। আম্মুতো ওর কথা জানে না তাই ওকে বাসায়ও আসতে বলতে পারলাম না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। জীবনে মনে হয় কোনোদিন এত অসহায় লাগে নি। যেকোনো মুহুর্তে বাবা চলে আসতে পারে তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও রহিমকে বিদায় দিয়ে বাসায় ঢুকতে হলো। ফেরার সময় বারবার পিছনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আমার বাবুটিও যেন যেতে চাচ্ছে না। তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। আসলে রহিমকে বাবু বলে ডাকার অন্য একটি কারণ আছে তা পরে বলবো। বাসায় ঢুকে বারান্দায় গিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকালাম দেখলাম রহিম এমনভাবে হাটছে যেন ১০৫ ডিগ্রী জ্বরে আক্রান্ত কোনো যুবক হেঁটে যাচ্ছে। রহিমের চেহারা এখন আর তেমন বুঝা যাচ্ছে না। হেঁটে হেঁটে যেন রাস্তার সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। তবে মাঝে মাঝেই আমাদের বাসার দিকে তাকায়। আমি আমার ডান হাতে একটু চুমু দিয়ে হাতটি রহিমের দিকে ছুড়ে দিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম হাতের উপর কয়েকফোটা জল। এরমধ্যেই আম্মু রুমে এসে বলল, তোর চোখে জল কেন? আমিতো থতমত খেয়ে গেলাম। সাথে সাথে ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছে একটু হাচি দিয়ে বললাম, হাচি আসছিল আম্মু। কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন যেন চিনচিন করছিল আমার বুবুটার জন্য।

 

পাঁচ ছয় মাস পরে প্রিয়তি তার সেই বান্ধবী সাগরীকাকে বলল, দোস্ত একটা কথা। কি কথা বল। তখন প্রিয়তির মুখে যেন মেঘ জমে আছে। সাগরীকা অবাক দৃষ্টিতে প্রিয়তির দিকে তাকিয়ে রইল আর মনে মনে বলল, যেই প্রিয়তির সাথে দেখা হলে রহিমের কথা বলে যেন হাসিতে মেতে উঠত আর আজ কি অসহায় তার চোখ, কি অসহায় তার মুখ।

সাগরীকা প্রিয়তিকে জিজ্ঞেস করলো, কি রে তোর মন খারাপ কেন? তোর চেহারার এমন অবস্থা কেন? সাগরীকাকে ধরে প্রিয়তি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সাগরীকাও আর নিজের কান্না ধরে রাখতে পারলো না। এরপর সাগরীকা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের ওড়না দিয়ে প্রিয়তির চোখ মুখ মুছে দিয়ে বলল, কি হয়েছে বল। কিছু হয়নিরে সাগরীকা তবে অনেক কিছু হয়ে গেছে, আজ আর তোর সহায়তা ছাড়া আমার মুক্তি নেই। সাগরীকা বলল, তোর সেই বাবুটা কই? এই কথা যেন প্রয়তির বুকের মধ্যে তীরের মতো বিদ্ধ হলো। প্রিয়তির ঠোঁট কাঁপতেছিল। কিছু বলতে চায় কিন্তু আবার ফিরিয়ে নেয়। এরপর অনেক কষ্টে মুখ খুলল প্রিয়তি, তুই বুজি আজ আমাকে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছিস। এই কথা কেন বলছিস? এতদিন তো আমাদের একটু সময়ও দিতি না। ক্লাশ শেষ না হতেই বাবুকে নিয়ে বের হয়ে যেতি। আগেতো বাসায় গিয়েও অনেক ফোন দিতি। বলতে পারবি তিন চার মাসের মধ্যে ভুলেও একবার আমাকে ফোন দিয়েছিলি? সাগরীকার কথায় প্রিয়তির বুকটি যেন ঝাজড়া হয়ে রক্ত বের হতে লাগল। প্রিয়তি পেটের মধ্যে তিন চার মাসের ভ্রুনটিও যেন বের হয়ে যেতে চাচ্ছে। মনে মনে বলছে, বের হয়ে যাক পেটের মধ্যে থেকে, তাহলে সকল আপদ মুক্ত হতো। প্রিয়তির চোখে আবার ঝর্নার মতো জল দেখে সাগরীকা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, সরি দোস্ত আসলে আমি বুঝতে পারিনি তোর মনে এত কষ্ট। আমাকে ক্ষমা করে দিস। বল কি হয়েছে তোর, আমাকে সব খুলে বল।

প্রিয়তি কাপাকাপা কন্ঠে বলল, আমাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি? আমার খুব লজ্জা করছেরে সাগরীকা তুই আর আমাকে লজ্জা দিছ না। এই বলে প্রিয়তি তার সামান্য উঁচু হওয়া পেটটিতে হাত দিয়ে দেখালো। সাগরীকার আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না।  শুধু মনে মনে বলল, আহারে প্রিয়তির সেই আদরের বাবুটিও আজ বাবুর বাবা হতে চলছে।

এরপর সাগরীকা প্রিয়তিকে বলল, তোর সেই বাবুটিকেও ডাক একসাথে যাই ডাক্তারের কাছে।

প্রিয়তি একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, তুই আর বাবু বাবু ডেকে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিছ না। বাবু এখন আর বাবু নেই। আমাকে একটি বাবু দিয়ে সে চলে গেছে। সে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তাকে এখন বাবু ডাকলে অপমান করা হবে। এখন অন্য কেউ তাকে বাবু ডাকে না, বর বলে ডাকে। আর সে এত তাড়াতাড়ি বর না হলেও বাবু বাবু ডাকার মতো নারীর এখন কি তার অভাব আছে? আর তুই? আমি এখন আর আমার বুকের সন্তানকে নষ্ট করবো না। আমি এই বুকের সন্তানকে নিয়েই স্বপ্ন দেখবো। ওকেই আমি বাবু বাবু ডেকে জীবনটা পাড় করে দেবো। এটাই আমার সান্ত্বনা।

 

সাগরীকা প্রিয়তিকে অনেক বোঝালো তারপর প্রিয়তি রাজী হলো। কয়েকমাস পরে নিউজ পেপারে একটি হেডালাইন হলো, “রাস্তার উপর ব্যাগে মোড়ানো জীবন্ত শিশু”। খবরটি মুহূর্তের মধ্যেই ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেল। সেই নীল পাঞ্জাবীওয়ালাও খবরটি শেয়ার করে লিখলো, ‘কিয়ামত খুবই সামনে চলে আসছে’। তার এই স্ট্যাটাস দেখে প্রিয়তীর বান্ধবী হাহা রিএ্যাক্ট দিলো। কিন্তু নীল পাঞ্জাবীওয়ালা বাবুটি কিছুই বুঝতে পারলো না। আর প্রিয়তি তো তার সেই প্রিয় বাবুটির ব্লক লিস্টেই আছে। সাগরীকা প্রিয়তিকে নীল পাঞ্জাবীওয়ালার স্ট্যাটাস স্কীনসট দিয়ে দেখালো। প্রিয়তি স্কীনসট দেখে চোখে একফোটাও জলও আনলো না। শুধু তাকিয়ে রইল স্কীনসটের উপরে গোলাকার ছোট্ট একটি ছবির (প্রোফাইল পিকচার) উপর। এই সেই নীল পাঞ্জাবীপড়া ছবি যা দেখে সে বাবুকে বর ভেবে নিয়েছিল বুকের মাঝে। প্রিয়তিও তার প্রোফাইলে লাল শাড়ি পড়া ছবিটি দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

০৩.২৫ এ এম

১৬-০৬-২০১৯

কাঁটাবন, ঢাকা

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *